সূচিপত্র
কলকাতা থেকে মাত্র একশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ক্যানিং শহরটি হল সুন্দরবনে প্রবেশের প্রধান গেটওয়ে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যানিং টাউন বা মাতলা নামেও পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান সুন্দরবনে প্রবেশের আগে এটিই শেষ রেলওয়ে স্টেশন ও রাস্তার শেষ প্রান্ত। সজনেখালি গেলে হোক বা ঝারখালি গোসাবা বা বাশিরহাট যাওয়া হোক — ক্যানিং থেকেই আপনার যাত্রা শুরু হবে।
এই গাইডে আপনি জানতে পারবেন কলকাতা থেকে ক্যানিং কীভাবে যাবেন ক্যানিং থেকে নৌকা কীভাবে বুক করবেন কোন ঘাট থেকে কোথায় যাবেন পারমিটের প্রক্রিয়া কী এবং কী কী সতর্কতা মেনে চলতে হবে।
ক্যানিং কোথায় অবস্থিত
ক্যানিং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত। কলকাতা থেকে এর দূরত্ব প্রায় একশ কিলোমিটার। সুন্দরবনের প্রধান প্রবেশ পথগুলি হল ঝারখালি সোনাখালি গোধখালি এবং নামখানা। ক্যানিং থেকে এই ঘাটগুলির দূরত্ব যথাক্রমে ২৫ ৩০ ৩৫ এবং ৫০ কিলোমিটার।
কলকাতা থেকে ক্যানিং কীভাবে যাবেন
ট্রেনের মাধ্যমে
কলকাতার সিয়ালদহ থেকে ক্যানিং পর্যন্ত প্রতি ত্রিশ থেকে ষাট মিনিট অন্তর লোকাল ট্রেন চলে। ভ্রমণ সময় প্রায় দুই ঘণ্টা। টিকিটের দাম অবরক্ষিত ক্লাসে বিশ থেকে ত্রিশ টাকা এবং চেয়ার কারে পঞ্চাশ থেকে সত্তর টাকা। সকাল সাতটা থেকে রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত ট্রেন পাওয়া যায়।
বাসের মাধ্যমে
এসপ্ল্যানেড থেকে ডব্লিউবিটিসি এবং বেসরকারি বাস ক্যানিং বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত চলে। ভ্রমণ সময় প্রায় তিন ঘণ্টা। ভাড়া পঞ্চাশ থেকে আশি টাকা। ট্রাফিকের উপর নির্ভর করে সময় বেড়ে যেতে পারে।
গাড়ি বা ট্যাক্সির মাধ্যমে
বসন্তী হাইওয়ে ধরে গেলে দুই ঘণ্টা তিন মিনিটের মধ্যে ক্যানিং পৌঁছানো যায়। এক পথের ভাড়া প্রায় এক হাজার আটশ থেকে দুই হাজার পাঁচশ টাকা। উবার বা সাভারি অ্যাপের মাধ্যমে আগে থেকে বুক করা ভালো।
ক্যানিং থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার পদ্ধতি
ক্যানিং থেকে সুন্দরবনে সরাসরি নৌকা পাওয়া যায় না। আপনাকে প্রথমে কোনও নৌঘাটে পৌঁছাতে হবে। ঝারখালি ঘাট সবচেয়ে জনপ্রিয় সজনেখালি দোবাঙ্কি ভাগবতপুরের জন্য। সোনাখালি ঘাট পাখিরালয় এবং পঞ্চমুখনির জন্য ভালো। গোধখালি ঘাট কম ভিড় এবং বাজেট ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। নামখানা ঘাট থেকে লোথিয়ান দ্বীপে যাওয়া যায়।
নৌকা বুকিং এবং পারমিট
কান্ট্রি বোট বা মোটর লঞ্চ বা প্রাইভেট স্পিডবোট — আপনার বাজেট ও পছন্দ অনুযায়ী নৌকা বাছতে পারেন। কান্ট্রি বোটের ভাড়া প্রায় তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। শেয়ার্ড মোটর লঞ্চে প্রতি ব্যক্তির জন্য আটশ থেকে বারোশ টাকা। প্রাইভেট স্পিডবোট ভাড়া আট থেকে বারো হাজার টাকা।
ফরেস্ট এন্ট্রি পারমিট বাধ্যতামূলক। ভারতীয় নাগরিকদের জন্য একশ থেকে দুইশ টাকা এবং বিদেশি নাগরিকদের জন্য পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা। পারমিট অনলাইনে sundarbanstourism.gov.in ওয়েবসাইট থেকে বা ঘাটের ফরেস্ট অফিস থেকে নেওয়া যায়। আধার কার্ড বা পাসপোর্ট এবং দুটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি জমা দিতে হবে।
ক্যানিংয়ে থাকার ব্যবস্থা
যদি রাত কাটাতে হয় বা ভোরে রওনা দিতে চান তাহলে ক্যানিংয়ে কয়েকটি হোটেল আছে। ক্যানিং লজ বা সুন্দরবন ট্যুরিস্ট লজ বাজেট ফ্রেন্ডলি। হোটেল রয়্যাল ইন বা সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ রিট্রিট মিড রেঞ্জের জন্য ভালো। সুন্দরবন টাইগার ক্যাম্প লাগজারি অভিজ্ঞতার জন্য উপযুক্ত।
খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস
ক্যানিং স্টেশনের কাছে মা ভবতারিণী ঢাবা বা ক্যাফে মাতলায় খাবার পাওয়া যায়। নগদ টাকা নিয়ে যান কারণ সুন্দরবনের ভেতরে অনেক জায়গায় কার্ড চলে না। মশারি সানস্ক্রিন ওয়াটারপ্রুফ কভার পাওয়ার ব্যাঙ্ক এবং ব্যক্তিগত ওষুধ সঙ্গে রাখুন।
সতর্কতা ও নিয়ম
লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফরেস্ট গাইড ছাড়া নৌকা চলবে না। আইডি কার্ড এবং পারমিটের কপি সঙ্গে রাখুন। হালকা রঙের লম্বা হাতার জামা পরুন। সকাল সাতটার মধ্যে নৌকা ছাড়ুন বিকেলের গরম এড়াতে। প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে যাবেন না। নদীতে হাত বা পা ডুবাবেন না। স্থানীয়দের ছবি তুলবেন না অনুমতি ছাড়া।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি শীতকাল সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। বাঘ দেখার সম্ভাবনা বেশি। মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যটক কম কিন্তু গরম পড়ে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর বর্ষাকালে নৌকা চলাচল সীমিত থাকে। অক্টোবর থেকে শুরু হয় শরতের সৌন্দর্য।
নমুনা ভ্রমণ পরিকল্পনা
প্রথম দিন সকাল ছটায় কলকাতা থেকে রওনা দিন। ট্রেনে করে ক্যানিং পৌঁছে যান। ট্যাক্সি করে ঝারখালি ঘাটে যান। সেখান থেকে নৌকায় করে সজনেখালি যান। বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং কুমির পার্ক দেখুন। দোবাঙ্কি ওয়াচ টাওয়ারে যান। রাত কাটান ফরেস্ট লজে।
দ্বিতীয় দিন সকালে ভাগবতপুর যান। হরিণ ও পাখি দেখুন। দুপুরের আগে ঝারখালি ঘাটে ফিরে আসুন। ক্যানিং হয়ে কলকাতায় ফিরে আসুন।
যোগাযোগের ঠিকানা
ক্যানিং ট্যুরিস্ট ইনফো সেন্টার 91 6295616886। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট হেল্পলাইন ১৮০০ ৩৪৫ ৪৫৫৭। জরুরি প্রয়োজনে ১১২ নম্বরে কল করুন। বিশ্বস্ত ট্যুর অপারেটরের জন্য www.sundarbantourpackage.com ওয়েবসাইট দেখুন।
প্যাকিং লিস্ট
আইডি কার্ড ও পারমিটের প্রিন্ট আউট। হালকা জামাকাপড় ও রেনকোট। মশা তাড়ানোর স্প্রে ও সানস্ক্রিন। পাওয়ার ব্যাঙ্ক ও ওয়াটারপ্রুফ কভার। বাইনোকুলার ও ক্যামেরা। নগদ টাকা। ব্যক্তিগত ওষুধ।
শেষ কথা
ক্যানিং শুধু একটি ট্রানজিট পয়েন্ট নয় — এটি প্রকৃতির রাজ্যে প্রবেশের দ্বার। সঠিক পরিকল্পনা করুন প্রকৃতিকে সম্মান করুন এবং সুন্দরবনের রহস্যময় জগতে হারিয়ে যান। বাঘ দেখুন নদী ভেসে চলুন বা শুধু শান্তি উপভোগ করুন — আপনার অ্যাডভেঞ্চার শুরু হবে ক্যানিং থেকেই।
বন কখনও কোলাহলপূর্ণ মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশ করে না — শুধু শুনতে চায় তাদের কাছেই সে কথা বলে।
এখনো কোন মন্তব্য নেই
আপনার মতামত শেয়ার করতে প্রথম হন!